রবিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:১২ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

মোদি না ভারতীয় জনগণ?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী:
নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে কেবল যে তার দল আছে তা তো নয়, আছে গোটা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। ভারতের এককেন্দ্রিক শাসন, তার শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, আইন-আদালত, আমলাতন্ত্র, স্বাধীন নির্বাচন কমিশন, সেনাবাহিনীসহ সব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী ও প্রতিরক্ষা বাহিনী, সবাই তার পক্ষেই আছে বলেই ধারণা করা যাচ্ছে। অর্থাৎ তারা পুঁজিবাদেরই পক্ষে। আর বিরোধী দলগুলোর বড় অংশটাও এই ব্যবস্থারই পক্ষে। সঙ্গে ভারতীয় পরিচয় নিয়ে গর্বিত ও সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্ত মানুষেরাও। বিজেপি কীভাবে কথিত উদারনৈতিকদেরও নিজের দিকে টেনে নিয়েছে তার বহু দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে। ধরা যাক, বহুল আলোচিত সাংবাদিক এম জে আকবরের কথাই। জন্মসূত্রে ইনি মুসলমান, লালিত-পালিত হয়েছেন হিন্দিভাষী ব্রাহ্মণ পরিবারে, সাংবাদিক হিসেবে ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ, মুসলমানদের পক্ষে লিখতেন, একসময়ে ছিলেন কংগ্রেসে, ওই দল থেকে কেন্দ্রীয় আইন সভার সদস্য পর্যন্ত হয়েছিলেন। কিন্তু আরও সুবিধা পাওয়ার লালসায় দলত্যাগ করে চলে গেলেন বিজেপিতে, দলের পক্ষে প্রচারে নামলেন, দল তাকে মূল্যায়ন করে ডেপুটি ফরেন মিনিস্টারই করে দিয়েছিল; তারপরই জানা গেল তার নৈতিক অধঃপতনের খবর। তিনি তার সংবাদপত্রে কর্মরত নারী কর্মীদের ওপর যৌন হয়রানির দায়ে অভিযুক্ত হলেন। ঘৃণিত হলেন সাংবাদিক মহলে এবং তার মন্ত্রিত্বটিও গেল চলে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, তার এই উত্থান-পতনের কোথাও ধর্মের বিন্দুমাত্র স্পর্শ নেই, সবটাই বস্তুবাদী।

বিজেপির রাজনীতির বিশেষ আকর্ষণ বস্তুগত সুবিধাদানের সক্ষমতার ভেতরেই নিহিত। মোদি-ম্যাজিকের প্রকৃত রহস্যও ওইখানেই। সুবিধা দিতে পারছে। কেবল যে মানসিক সুবিধা তা নয়, ব্যবহারিক সুবিধাও, পাশাপাশি ধর্মীয় মাদকতা। লোকে আসবে না কেন? প্রয়োজনে গেরুয়াও পরবে। গেরুয়া পরলেই যে লোকে সাধু-সন্ন্যাসী হয়ে যাবে তা নয়, আবার এমনও নয় যে, কেবল সাধু-সন্ন্যাসীরাই গেরুয়া পরে। রাজনৈতিক গেরুয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। সেখানে এমনকি বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরাও কম সহিংস নয়, মানুষ তারাও মারে, ঘরে আগুন দেয়, ধর্ষণ করে, গণহত্যায় লিপ্ত হয়ে নিরীহ মানুষকে দেশছাড়া করে। সাক্ষী মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা ও শ্রীলঙ্কার অবৌদ্ধরা। সিনেমার তারকাদের তো ধার্মিক হওয়ার কোনো দায় নেই, অন্যরকম হলেই বরং তাদের সুবিধা, দেখা গেছে তারকালোকের ওই বাসিন্দারাও মুগ্ধ মোদির ঐন্দ্রজালিক দক্ষতায়। কারণটা ওই একই, প্রাপ্তির লালসা। বিজেপি মস্ত সুবিধা পেয়েছে মিডিয়ার কাছ থেকে। মিডিয়া তো এখন অসীম ক্ষমতা রাখে। অধঃপতিত আকবর সাহেব যে অত উঁচু মর্যাদা পেয়েছেন তার প্রধান কারণ তিনি মিডিয়ার লোক ও মিডিয়া ম্যানিপুলেশনে দক্ষ। মিডিয়া কিন্তু কখনোই নিরপেক্ষ থাকে না, থাকে মালিকের পক্ষে। মোদির দলে যেহেতু পুঁজিওয়ালা ও পুঁজিবাদের সুবিধাভোগীদের বিশেষ সমারোহ মিডিয়া তাই তার পক্ষেই কাজ করেছে। ভেক ধরেছে যদিও নিরপেক্ষতার।

আর কেবল দেশি পুঁজিপতিরাই যে অজস্রধারায় এসেছে তাও তো নয়, মোদির পক্ষে বিদেশি পুঁজিপন্থিরাও আছে। তাদের স্বার্থ আর মোদির স্বার্থ তো একই। তাই দেখা গেল গুজরাটে মানুষ পুড়িয়ে মারার অভিযোগের দরুন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মোদিকে সন্ত্রাসী জ্ঞানে ভিসা দেবে না বলে ঘোষণা জারি করেছিল, প্রধানমন্ত্রীর আসন পাওয়ার পর তাকেই তারা আদর করে কাছে টেনেছে। নির্বাচনের আগে টাইম পত্রিকা মোদিকে বলেছিল বিভাজনের গুরু, মোটেই মিথ্যা বলেনি; কিন্তু মোদি প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন দেখে অতিদ্রুত সুর পাল্টে বলা শুরু করেছিল তিনি হচ্ছেন ঐক্যের কান্ডাারি। মোদি বদলাননি, অহিন্দুদের বিরুদ্ধে তিনি আরও উগ্র হয়েছেন, আশঙ্কা করা যায় আরও বাড়বে তার উগ্রতা কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বের পুঁজিবাদী স্বার্থ তার বিরুদ্ধে যাবে না, তার সঙ্গেই থাকবে। পোশাকটাই যা আলাদা, নইলে মোদিও যা পুঁজিবাদী স্বার্থবাদীরাও তা-ই; একই নৌকার যাত্রী। এটা মোটেই অস্বাভাবিক ঘটনা নয়, তবে তাৎপর্যহীনও নয় যে, মোদির সঙ্গে বিশেষ সখ্য ইসরায়েলের বর্ণবাদী রাষ্ট্রনেতাদের।

পশ্চিমবঙ্গের ব্যাপারটা ছিল আলাদা। দল হিসেবে হিন্দু মহাসভার জনপ্রিয়তা সেখানে সীমিতই ছিল, মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকান্ডাের পরে সেটা প্রায় নিঃশেষই হয়ে গিয়েছিল। বাবরি মসজিদের ঘটনাকে কেন্দ্র করে অন্য রাজ্যে যখন দাঙ্গাহাঙ্গামা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ তখন শান্তই ছিল। রাজ্যের বামফ্রন্টের ভালো কাজগুলোর একটি ছিল সাম্প্রদায়িকতাকে মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে না দেওয়া। এমনকি দশ বছর আগের নির্বাচনেও পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি সুবিধা করতে পারেনি, আসন পেয়েছিল মাত্র দুটি। মমতা দিদি হুঙ্কার দিয়ে বলেছিলেন বিজেপি এবার একটাও পাবে না। তারা আসন কেবল যে পেয়েছে তা নয়, মমতার বাইশটির বিপরীতে আঠারটি দখল করে নিয়েছিল। এমন আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল রাজ্যের আগামী নির্বাচনে তৃণমূলকে হটিয়ে তারাই ক্ষমতা দখল করে নেবে। মমতার দল ছেড়ে ইতিমধ্যেই মোদির দলে অনেকে ভিড়ে গেছে, আরও অনেকে হয়তো যাবে নির্বাচনে মোদি জিতলে। সাতচল্লিশের সময় দেশভাগের ব্যাপারে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস যে বিশেষ রকমের আগ্রহী হয়ে পড়েছিল তার একটা কারণ কলকাতা শহরকে দখলে রাখার আশায়। তারপর থেকে বাঙালিদের হটিয়ে দিয়ে কলকাতা ক্রমাগত সর্বভারতীয় পুঁজিপতিদের অধীনে চলে গেছে, এবার কেবল কলকাতা নয়, গোটা পশ্চিমবাংলাই হয়তো চলে যাবে তাদের কর্তৃত্বে, যদি মোদি নির্বাচনে জয়ী হয়ে আসে।

মমতা বাঙালি জাতীয়তাবাদের পতাকা সদম্ভে উড্ডীন করেছিলেন। তিনি যে কেমন বাঙালি জাতীয়তাবাদী সেটা তো ভালোভাবেই টের পাওয়া গেছে যখন তিস্তার পানির হিস্যা না দিয়ে বাংলাদেশের তাবৎ বাঙালিকে কাবু করার ব্যাপারে তার প্রচ- আগ্রহ দেখা গিয়েছিল। এক্ষেত্রে বাঙালি মমতার বাংলাদেশ-বিরোধী মনোভাব গুজরাটী মোদিকেও লজ্জায় ফেলেছিল। অন্ততপক্ষে নামে হলেও ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী কংগ্রেসকে এবং তারপর পুরোপুরি ধর্মনিরপেক্ষ বামফ্রন্টকে তিনি হটালেন এবং উভয় ক্ষেত্রেই সহায়ক শক্তি হিসেবে পেলেন বিজেপিকে। তারপরই হঠাৎ করে বাঙালি জাতীয়তাবাদী সেজে বাংলা, হিন্দি ও ইংরেজি ভাষায় সমানে বাঙালিদের স্বার্থের পক্ষে সোরগোল শুরু করলেন এবং শেষ পর্যন্ত এমন ব্যবস্থা করলেন যাতে বিজেপি যেটা স্বপ্নেও ভাবেনি সেটাই সম্ভব হয়ে গেল বিজেপির জন্য পশ্চিমবঙ্গের দখলদারিত্বের রাস্তা খুলে গেল। বোঝা গেল আসলে মমতা দিদিও বিজেপির মতোই পুঁজিবাদী। নামেই যা পার্থক্য। বোঝা গেল পুঁজিবাদীদের হাতে কোনো কিছুই নিরাপদ নয়, এমনকি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষামূলক যে জাতীয়তাবাদ সেটাও নয়। মোদি জিতলে মমতা ব্যানার্জিকে হয়তো রণক্ষেত্রে আর তেমন একটা দেখা যাবে না। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের যে ক্ষতিটা তিনি করে দিয়ে গেলেন তার মাশুল সেখানকার মানুষকে তো বটেই, পৃথিবীর নানা প্রান্তে যে বাঙালিরা আছে তাদেরও বহন করতে হবে, বাংলাদেশের বাঙালিদের গায়ে তো আঁচ লাগবেই।

এই নির্বাচনে বামপন্থিরা পুনরায় ইন্ডিয়া জোটের অংশ হয়ে ফিরে আসার সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরাতে তাদের ঘাঁটি ছিল, সে ঘাঁটি হাতছাড়া। কেরালাতে কোনো মতে মাথাটা উঁচু করে রেখেছে। বামবিরোধীরা তো অবশ্যই, উদারনীতিকরাও মনে হচ্ছে সেটা দেখে বেশ আমোদে আছেন। তারা হয়তো জানেন না যে, চরম দক্ষিণপন্থিদের বিরুদ্ধে আগামীতে যদি কেউ দাঁড়ায়, তবে দাঁড়াবে ওই বামপন্থিরাই। তবে ততদিনে হয়তো বামপন্থিদের এই বোধোদয়টা ঘটবে যে ভারতের জাতি সমস্যা সমাধান না করলে শ্রেণি সমস্যা সমাধানের চেষ্টা অকার্যকরই রয়ে যাবে। পুঁজিবাদীদের হিন্দুত্ববাদের মানববিদ্বেষী মায়াজাল ও ঘৃণা ছড়ানোর তৎপরতার আঘাতে শ্রেণি সমস্যাটা আড়ালে চলে যাবে, এখন যেমন গিয়েছে ও যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, এবং সেটাই হয়তো প্রথম, তাদের কাজ করতে হবে সমাজবিপ্লবের লক্ষ্যে। কোনো বামপন্থিই প্রকৃত অর্থে বামপন্থি নয়, যদি সমাজ বিপ্লবী না হয়। বামপন্থিরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারে, কিন্তু নির্বাচনপন্থি হয়ে পড়লে বামপন্থিদের যে ভবিষ্যৎ নেই সেটা তাদের বর্তমান দুর্দশাই বলে দিচ্ছে। নির্বাচনের মোহ বিপ্লবী চেতনাকে গ্রাস করে ফেলবার ক্ষমতা রাখে। এবং গ্রাস করে ফেললে অবস্থাটা কেমন দাঁড়ায় সিপিএমের দুর্দশা তার জীবন্ত সাক্ষী। বামপন্থিদের আরও একটা কাজ করা চাই। সেটা হলো সাংস্কৃতিক তৎপরতাকে বিস্তৃত ও গভীর করা। সামাজিক বিপ্লব ও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সম্পর্কটা একেবারে অঙ্গাঙ্গী।

ভারতের জনগণ আপাতত হেরে গেছে, কিন্তু এটা চূড়ান্ত ঘটনা হতে পারে না এবারের নির্বাচনই মোদি জিতবে না জিতবে ভারতের জনগণ। সেটা না হলে বুঝতে হবে ভবিষ্যৎ বলতে অন্ধকার ভিন্ন অন্য কিছু নেই।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ভয়েস/আআ

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION